ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

OMR পদ্ধতিতে ডাকসুর নির্লজ্জ ডিজিটাল কারচুপি

মাশরুর ই সাত্তার উজ্জ্বল
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:২৮ এএম
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:৫৮ পিএম
OMR পদ্ধতিতে ডাকসুর নির্লজ্জ ডিজিটাল কারচুপি

০১.

ডাকসুতে OMR পদ্ধতিকে বেছে নেওয়া হয়েছে ভোট কারচুপির জন্য। যে পদ্ধতি ব্যবহার করে MCQ পরীক্ষার খাতা যাচাই করা হয়। OMR মেশিনটি ছিল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হওয়ার উপযুক্ত মেশিন। ফলে, নির্দিষ্ট অপশন ব্যবহার করে দূর থেকেও এটি নিয়ন্ত্রিত করা যায়।

০২.

OMR পদ্ধতির একটি বিশেষায়িত নিয়ম হলো, ওই কাগজে বাড়তি কোনো প্রকার দাগ থাকলে সেটা বাতিল বলে গণ্য হবে। ধরা যাক, একটি ব্যালটের কোনো প্রান্তে একটি দাগ দিয়ে দেওয়া হলো। যা স্বাভাবিকভাবেই ভোটারের নজর আকর্ষণ করার কথা নয়। তাছাড়া, ভোট দিতে হয়েছে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ অবস্থায়, দ্রুত, তাড়াহুড়োর মধ্যে। এভাবে, যতগুলো ব্যালটে একটু হলেও দাগ দেওয়া থাকবে, সবগুলো ভোট কাস্টিং হলেও, ভোট হিসেবে গণ্য হবে না।

০৩.

কোন ব্যালটটি নষ্ট করতে হবে, আর কোনটি অক্ষত রাখতে হবে, সেটি দায়িত্বরত ব্যালট সরবরাহকারী কীভাবে বুঝবে? এটি অত্যন্ত সহজ ছিল। কারণ, কেন্দ্রগুলোতে পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে যারা নিয়োজিত ছিলেন, তারা ছিলেন ঢাবি ভিসির বিশেষ ক্ষমতাবলে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত। তাছাড়া, তাদের কাছে শিক্ষার্থীরা পরিচিতও বটে। সব শিক্ষার্থী না হলেও অন্তত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিক্ষার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় তাদের জানা। এভাবে ব্যালট পেপারের একটা বড় অংশ অযাচিত দাগ দিয়ে নষ্ট করে নির্দিষ্ট প্যানেলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব সম্ভব। ঠিক একই কাজ ব্যালট বাক্স খোলার পরেও সম্ভব। (ছোট্ট করে দাগিয়ে)

০৪.

OMR মেশিনটি নির্দিষ্ট একটি প্রোগ্রাম দ্বারা চালিত। প্রোগ্রামটি কে বা কারা ডেভেলপ করেছে, সেটা বড় ফ্যাক্টর। প্রোগ্রামটিতে এমন কোডিং রাখা সম্ভব, যার ফলে নির্দিষ্ট সিরিয়াল নাম্বারের প্রার্থীর পক্ষে প্রতিটি ভোটের জন্য একটি ভোট কাউন্ট না হয়ে একাধিক ভোট কাউন্ট হবে। যেমন: ৫০ জন প্রার্থীর জন্য ৫০ টি সিরিয়াল নাম্বার আছে। কিন্তু যদি সাদিক কায়েমের জন্য নির্ধারিত ২২ নাম্বার সিরিয়াল নাম্বারের ক্ষেত্রে প্রতি ভোটের বিপরীতে ৩ টি করে কাউন্ট করার প্রোগ্রাম করা থাকে, তবে সেভাবেই কাউন্ট হতে থাকবে।

০৫.

এজাতীয় মেশিনে একাধিকভাবে কাউন্ট করার অপশন থাকে। যেমন: একটি থাকে যন্ত্রটির ডিফল্ট অপশন। তারপর, আরো অনেকগুলো এডিট করার মতো অপশন। যদি হঠাৎ মেশিনের এমন পদ্ধতি ধরা পড়ে যায়, তবে তাৎক্ষণিক ডিফল্ট অপশনে যাওয়ার অপশন থাকে। ফলে, একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে মেশিনটির মেশিনারি ধরা সম্ভব হয় না।

০৬.

পূর্বেই বলা হয়েছে, আধুনিক OMR মেশিনগুলো ওয়াইফাই সহ বিভিন্ন ধরণের নেটওয়ার্কে কানেক্ট হওয়ার উপযুক্ত। যার মাধ্যমে দূর থেকে মেশিনটির অপশন, ইনপুট, আউটপুট, রিডিং, সব কন্ট্রোল করা যায়। যদি এমন হয়, উপস্থিত ক্ষেত্রে মেশিনটির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য পূরণ করা যাচ্ছে না। তবে দূর থেকে হলেও সেটি সম্ভব। সেক্ষেত্রে সাম্প্রতিক OMR মেশিনগুলোতে পাসওয়ার্ড সিস্টেম রয়েছে। অর্থাৎ, মেশিনটির প্রোগ্রামার ও অপারেটরের হাতেই সকল ক্ষমতা। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, যার কাছে পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে, তারও ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ আছে।

এটা গেল OMR কারচুপির ব্যাপার। এবার চলুন দেখা যাক, ডাকসু নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণায় অসঙ্গতিসমূহ:

ক.

কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে OMR পদ্ধতির কারচুপিতে প্রায় সকল সম্পাদকীয় পদ ছাত্রশিবির নিতে পারলেও, বিস্ময়করভাবে ঢাবির হলগুলোতে ভিপি, জিএস ও এজিএস পদে কোনো হলের একটিতেও তারা নির্বাচিত হয়নি! অথচ, সেখানে সব হল মিলিয়ে ৫৪ টি শীর্ষস্থানীয় পদ ছিল। ৫৪ পদের বিপরীতে শিবিরের অর্জন শূন্য। অবাক করা তথ্য নয়? এমন উদ্ভট ও অসঙ্গতি ব্যাপার ডাকসুর এ যাবতকালের ইতিহাসে কখনোই হয়নি! একমাত্র OMR মেশিনের একপাক্ষিক রোবটের কাণ্ডকারখানাই এমন ফল সম্ভব। এনালগ সিস্টেমে মানুষের মাধ্যমে কারচুপি হলে অন্তত কিছুটা হলেও বাস্তবতার সাথে মিলতো।

খ.

ভিপি পদে সাদিক কায়েম ভিপি পদে যেখানে ১৪০৪২ ভোট পেয়েছে, সেখানে শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি পেয়েছেন মাত্র ৬৮ ভোট। অথচ, তিনি তার হলেরই সর্বশেষ ভিপি ছিলেন। ৩৯ হাজার ভোটের মধ্যে কেবল ৬৮ টি ভোট পাওয়া কি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে আপনার কাছে? যেখানে তারই প্যানেলে মেঘমল্লার পেয়েছেন ৪৯৪৯ ভোট! পার্থক্য অস্বাভাবিক। ভারসাম্যহীন অবাস্তব ফলাফল।

গ.

তাছাড়া, অনেক পদে ভোট পড়েছে শূন্য। অর্থাৎ প্রার্থীর নিজের ভোটও কাউন্ট হয়নি। কারো ক্ষেত্রে দুটি বা তিনটি।

ঘ.

ভোট দেখানো হয়েছে প্রায় ৮০ পার্সেন্ট। যা ডাকসুর কোনো নির্বাচনেই হয়নি। এটাও অস্বাভাবিক। তাছাড়া, এবারের নির্বাচনে বর্তমানে নিষিদ্ধ থাকা ছাত্রলীগের কর্মী সমর্থক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ভোটকেন্দ্রে আসেননি। ফলে, একটি বড় অংশের ঘাটতি ছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। তারপরেও ৮০ পার্সেন্ট ভোট পড়ার দাবি কেবল অযৌক্তিকই নয়, অলৌকিক দাবির সমতুল্য!

ঙ.

উমামা ফাতেমা সহ, ইমি, আবিদ প্রত্যেকেই নির্বাচন চলাকালীনই ভোট কারচুপির ব্যাপারে দুপুর থেকেই বলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তারা তো বটেই, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই প্রকৃতপক্ষে OMR মেশিনের প্রক্রিয়া বা কার্যক্ষমতার সাথে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন না। মূল কারচুপির মূল গলদটা তাৎক্ষণিক ধরা যায়নি।

পুনশ্চ: জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতির টেন্ডার নিয়েছিলেন জামায়াতের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। সেটি গোপন করা যায়নি। জাকসুর ভোট কারচুপি ইতোমধ্যে জনপ্রকাশ্যে এসেছে। এবার তবে, ডাকসু নির্বাচনের OMR-এর প্রযুক্তিগত কারচুপি নিয়েও তদন্ত শুরু করা হোক শক্তভাবে। তা না হলে, ইতিহাসে সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি লজ্জাজনক কলঙ্ক হিসেবেই থাকবে।

ডাকসুর ফলাফল অবশ্যই স্থগিত করতে হবে। প্রতিটি বিষয় তদন্ত করতে হবে। বিশেষ করে, OMR মেশিনের টেন্ডার কে নিয়েছিল, আর কারা ছিল অপারেটর, এই বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বের করতে হবে। জনগণ জানুক এই নির্লজ্জ ভোট কারচুপির ঘটনা।

লেখক: মাশরুর ই সাত্তার উজ্জ্বল

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

একতারার কান্না ও অঙ্গার হওয়া শৈশব: বাংলাদেশ কি তবে অন্ধকারের মরণফাঁদে?

রাজনীতির দাবা খেলা / নিয়োগকর্তারা সব চলে গেলেন, কিন্তু নিয়োগ বহাল থাকল

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

১০

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১১

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১২

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১৩

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১৪

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৫

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৬

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৭

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৮

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৯

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

২০